Autism & Neuro-Development Diseases
অটিজম সম্পর্কে আমাদের সবারই যা জানা প্রয়োজন
অটিজম কেন হয়?
মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধির বা পরিপক্বতার হেরফেরের কারণেই একটি শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয়। কিন্তু কেন এই হেরফের, তা অজানা। তবে গবেষকরা মনে করেন নিচের কারণগুলো অটিজমের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
১. জিনগত সমস্যা
২. রোগজীবাণুর সংক্রমণ
৩. শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ায় গোলমাল
৪. পরিবেশগত সমস্যা
শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত কিনা তা জানার উপায় কি?
যেহেতু এটি একটি সমষ্টিগত আচরণের সমস্যা, তাই অনেক অটিস্টিক শিশুর সব লক্ষণ থাকে না। তবে ‘অটিজম স্পেকট্রাম অব ডিজঅর্ডার’ বা অটিজমের লক্ষণ গুলোকে তিনটি প্রধান ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে:
১. সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অপারগতা
- অটিজম আছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাভাবিক একটি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, যেভাবে সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরি করে, সে তা করতে পারে না।
- বাবা-মা বা প্রিয়জনের চোখে চোখ রাখতে, মুখভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের চাওয়া বা না-চাওয়া বোঝাতে সে অপারগ হয়।
- সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। অমিশুক প্রবণতা থাকে।
- কোন ধরনের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় না। যেমন, স্বাভাবিক একটি শিশু কোন খেলনা হাতে পেলে তার দিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন খেলনার প্রতি তার নিজের কিছু আগ্রহ থাকলেও সেটা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না।
- শারীরিক আদর, চুমু দেওয়া এবং চেপে ধরে কোলে নেওয়া তারা মোটেই পছন্দ করে না।
২. যোগাযোগের সমস্যা
- আশপাশের পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে, কেবল কথা শিখতে দেরি হওয়া মানেই অটিজম নয়।
- কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে হয়তো পারে, কিন্তু একটি বাক্য শুরু করতে তার অস্বাভাবিক দেরি হয়। অথবা বাক্য শুরু করার পর তা শেষ করতে পারে না।
- কখনো দেখা যায়, একই শব্দ বারবার সে উচ্চারণ করে যাচ্ছে।
- তিন বছরের কম বয়সী শিশুরা তার বয়সের উপযোগী নানা রকমের খেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই তৈরি করে খেলে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এ রকম করে না।
৩. আচরণের অস্বাভাবিকতা
- একই আচরণ বারবার করতে থাকে।
- আওয়াজ পছন্দ করে না।
- তারা রুটিন মেনে চলতে ভালোবাসে। দৈনন্দিন কোনো রুটিনের হেরফের হলে তারা মন খারাপ করে।
- কোনো কারণ ছাড়াই দেখা যায় তারা হঠাৎ রেগে ওঠে বা ভয়ার্ত হয়ে যায়।
কোন বয়সে ও কিভাবে অটিজম প্রথম সনাক্ত করা সম্ভব?
যত দ্রুত অটিজম রোগটি সনাক্ত করা যায়, শিশুর জন্য ততই মঙ্গল। সাধারণত ৩ বছর বয়সের পর শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত কিনা তা দ্ব্যর্থহীনভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে মা-বাবারা সচেতন থাকলে ও বাচ্চার আচরণের দিকে ভাল ভাবে লক্ষ্য রাখলে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যেই সমস্যাটি আঁচ করতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে অটিজম সনাক্তকরণ সম্ভব তা হল:
- শিশুর দেরী করে হাসতে শেখা (সাধারণত শিশু জন্মের ছয় মাসের মধ্যে হাসতে শেখে। কিন্তু অটিস্টিক শিশু ছয় মাসেও হাসে না),
- কথা না বলা বা ঠিকমত না বলা (শিশুরা সাধারণত এক বছর বয়সের মধ্যে কিছু না কিছু শব্দ উচ্চারণ করে, কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এক বছরের মধ্যে মুখে কোনো শব্দ করে না। আঙুল দিয়ে কিছু নির্দেশ করে না, কোনো কিছু চাওয়া বা চাওয়ার ভঙ্গি করে না। ১৬ মাসেও কোনো শব্দ উচ্চারণ না করা। দুই বছরের মধ্যে দুটি শব্দ বলতে না পারা।)
- কানে না শোনা ( শিশুটিকে নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া)।
অটিস্টিক শিশুদের বিভিন্ন পর্যায়গুলো কি কি?
সাধারণত অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ৪টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। বয়সের সাথে নয় বরং প্রতিটি শিশুর সামর্থের উপর তার পর্যায় নির্ভর করে।
প্রথম পর্যায় (আত্মকেন্দ্রিক): এই পর্যায়ে শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক থেকে এবং আপন মনে একাকী খেলতে পছন্দ করে। এরা সাধারণত কোন আদেশ-নিষেধ অথবা নির্দেশ বুঝতে পারে না ও পালন করে না।
দ্বিতীয় পর্যায় (অনুরোধকারী): এই পর্যায়ের শিশুরা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে খুব কাছের লোকদের সাথে অল্প সময়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য অনুরোধ করে।
তৃতীয় পর্যায় (যোগাযোগ স্থাপনকারী ): এই পর্যায়ের শিশুরা কিছু প্রচলিত শব্দ বুঝতে পারে এবং অতি পরিচিত মানুষের সাথে অল্প সময়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। তারা ছোটখাট আদেশ-নির্দেশ পালন করতে পারে।
চতুর্থ পর্যায় (সহযোগী): এই পর্যায়ের শিশুরা পরিচিত সমবয়সী শিশুদের সাথে অল্প সময়ের জন্য খেলা করে। ভাষায় দক্ষতা একটু ভালো এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
অটিস্টিক শিশুরা কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে?
অটিস্টিক শিশুদের যোগাযোগে ভিন্নতা থাকে। যেহেতু তারা প্রচলিত সামাজিকতার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে না, তাই তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে। অনেক অটিস্টিক শিশু সারা জীবনেও কথা বলে না। কিছু শিশু প্রথম দিকে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করে (উহ্, আহ্, বাহ্), কিন্তু হঠাৎ তা বন্ধও করে দেয়। কোন কোন শিশু আবার দেরিতে কথা বলে। কেউবা আবার অগোছালো ও অর্থহীন কথা বলে। কোন কোন শিশু একই কথা বা শব্দ বারবার বলতে থাকে। আসলে সে তার অনুভূতি বোঝাতে চায়, কিন্তু পারে না।
তাই দেখা যায় অটিস্টিক শিশুরা মাথা নেড়ে, হাত নেড়ে, কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গ ভঙ্গিমায় তার মনের ভাব প্রকাশ করে। যেমন হাঁ-বোধক, না-বোধক অনুভূতি মাথা নেড়ে বোঝায় অথবা খিদে পেলে প্লেটের কাছে, ফ্রিজের কাছে, চুলার কাছে অন্যকে টেনে নিয়ে যায়। পেটে হাত দিয়ে বসে থাকে। বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে টেনে নিয়ে যায়, কোনো কিছু চাওয়ার থাকলে চিৎকার করে, রেগে যায়, মন খারাপ করে।
একটি নিজস্ব রুটিনমাফিক জীবন তারা বেছে নেয়। যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুম থেকে উঠে, খায়, ছবি আঁকে ইত্যাদি। কিন্তু এই রুটিনের ব্যত্যয় ঘটলে তারা মানতে পারে না। রেগে গিয়ে জিনিসপত্র নষ্ট করে।
অটিস্টিক শিশুটির পরিচর্যা ও চিকিৎসা
অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে। আরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে না। তারা বাসায় থাকে বা তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত স্কুল ও বিশেষ প্রশিক্ষণের। বিশেষায়িত স্কুলে পড়ে, ভাষাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা সমাজে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থান করে নেয়। কিন্তু বাদবাকি প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু যাদের অটিজম আছে, তারা সহায়তা পাওয়ার পরও স্বাধীন বা এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। তাদের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘদিন; প্রায় সারা জীবনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরতা। তা ছাড়া বিশেষ আবাসন, নার্সিং কেয়ারের প্রয়োজন হয় তাদের। ধৈর্য সহকারে অটিস্টিক শিশুটিকে যে সব বিষয়ে প্রশিক্ষন দিতে হবে সেগুলো নিম্নরূপ:
স্বাবলম্বীতা বিকাশঃ বেঁচে থাকার জন্য যে কাজগুলো করা অবশ্যই দরকার সেগুলো প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেমনঃ টয়লেট ও ওয়াশ করা, জামা ও জুতা পরিধান করা, দাঁত ব্রাশ করতে পারা, মাথা আচরাতে পারা, নিজে নিজে খেতে পারা ইত্যাদি। খাওয়ার এবং ঘুমের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে খুব বেশি খেয়ে মুটিয়ে না যায় এবং দিনের বেলা ঘুমিয়ে রাতে নিজে এবং অন্য সকলের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।
সংবেদনশীলতার সমম্বয়ঃ
এই ধরনের শিশুদের সংবেদনশীতা অত্যান্ত প্রখর অথবা অপ্রতুল হওয়াতে তাদের সংবেদনশীলতার সমম্বয় না করা হলে কোন কিছু শিখতে কিংবা মনসংযোগ করতে অনেক বিলম্ব হয়। বর্তমানে এ ধরনের শিশুদের প্রশিক্ষণের জন্য এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
ফিজিও এবং অকুপেশনাল প্রশিক্ষণঃ অনেক অটিষ্টিক শিশুর বিভিন্ন মাংসপেশী, চোখ ও হাতের যথাযথ সমম্বয় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাযথভাবে পরিপক্কতা ও পরিপূর্ণতার ঘাটতি থাকে। যথাযথ ফিজিওথেরাপি এবং অকুপেশনাল থেরাপি প্রয়োগ করলে এসব ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী ফলাফাল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রশিক্ষণের সাথে সাথে এ বিষয়টিকেও গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কথা ও ভাষা বিকাশঃ
অটিষ্টিক শিশুদের কথা ও ভাষা প্রশিক্ষণ অন্যান্যদের চেয়ে বেশ কঠিন কারণ তারা চঞ্চল এবং বেশিক্ষণ মনসংযোগ করতে পারে না। কথা ও ভাষা শিক্ষণের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবেঃ
- শিশুদের সাথে মুখোমুখি এবং একই উচ্চতায় ও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে।
- ঠোঁটের নাড়াচাড়া এবং চোখের ও হাতের সঞ্চালন অনুসরণ করতে সাহায্য করতে হবে। যে কোন কার্যক্রম করার সময় শিশুর সাথে কথা বলে কাজটি করতে হবে এবং শিশুকে দিয়ে করাবার চেষ্টা করতে হবে।
- স্বাভাবিকভাবে শিশুটি কোন শব্দ উচ্চারণ করলে তাকে অর্থপূর্ণ শব্দে রূপান্তর করার চেষ্টা করতে হবে।
- শুরুতে অতি দরকারি কিছু সহজ এবং এক সেলেবলযুক্ত শব্দ নির্বাচন করে সেগুলো শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন মা, বাবা, পানি, ভাত, জামা, জুত, বই, বল ইত্যাদি।
- শেখানো কথাগুলো বার বার এবং প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করতে হবে যাতে কোনভাবেই শিশুটি শিখে ফেলা শব্দগুলো ভুলে যেতে না পারে। সাথে সাথে এক শব্দের সাথে অরেকটি শব্দ যুক্ত করে দুই শব্দের বাক্য শেখানো চেষ্টা করতে হবে। যেমন- পানি খাব, জামা দাও, বই দাও, বল নেব ইত্যাদি।
- শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ছবির বই, দরকারি জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখিয়ে ধীরে ধীরে শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।
- কথা বলতে না পারলে তাকে ছবির ভাষা দেয়ার চেষ্টা করতে হবে যেন ছবি দেখিয়ে তার চাহিদা বুঝাতে পারে।
- এরপর ধীরে ধীরে অক্ষর, সংখ্যা, ছড়াগানের ক্যাসেট, ভিডিও ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে হবে এবং শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।
- যেসব কথাগুলো বলতে পারবে সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবে ব্যবহার করতে এবং অভ্যাস করতে হবে।
সামাজিকতা ও আচরণগত বিকাশঃ
অটিষ্টিক শিশুদের প্রয়োজনীয় সামাজিক আচরণ শেখাতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব কার্যক্রম করতে হবে তা নিম্নরূপঃ
- সমবয়সী শিশুদের সাথে মিশতে ও ভাবের আদান-প্রদান করতে সহায়তা করতে হবে।
- কখনই একাকী খেলতে দেয়া যাবে না। অন্য কারো সাথে খেলতে দিতে হবে এবং একে অন্যের মাধ্যমে কোন কিছু আদান প্রাদান করা শেখাতে হবে।
- সম্ভাষণ করতে পারা, হাসির জবাবে হাসি, আনন্দ প্রকাশ, করমর্দন সালাম প্রদান, বিদায় সুচক হাত নাড়া, শরীরিক স্পর্শদ্বারা বন্ধুত্ব করতে পারা ইত্যাদি শেখাতে হবে।
- আদান-প্রদানমূলক খেলা যেমন- বল দেয়া-নেয়া, গাড়ি দেয়া-নেয়া ইত্যাদি নিয়ম করে শিশুদের সাথে খেলতে হবে প্রথমে সহজ যেমন লুকোচুরি, টুকি ইত্যাদি থেকে ধীরে ধীরে গঠনমূলক খেলা খেলতে হবে।
- শিশুকে খেলার মাঠে-পার্কে নিয়ে যেতে হবে এবং সহজভাবে চলাফেরা করতে দিতে হবে।
- তত্ত্বাবধানের সাথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যান্যদের সাথে খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
- শিশুটিকে সকল সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নিয়ে যেতে হবে। এটা ধরো না, ওটা করো না, সারাক্ষণ এই জাতীয় নিয়ন্ত্রন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- কেউ যেন শিশুটিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে, বিরূপ সমালোচনা না করে এবং কোন কঠিন আচরণ না করে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
জরুরী বিষয়গুলো শেখানোর উপায় কি?
প্রথমেই নিশ্চিত হোন আপনার শিশুটি কি কি জিনিস, বিষয়, খাবার, খেলনা ইত্যাদি খুব পছন্দ করে। এগুলো প্রশিক্ষণ সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রশিক্ষণ সহায়ক বিষয়টিকে শিশুর দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখে তাকে আস্বস্ত করতে হবে যে নির্দেশিত কাজটি করলে তার পছন্দের জিনিসটি দেয়া হবে। এভাবে শিক্ষণীয় কাজটি সে নির্ভুল করে একনাগাড়ে ৩-৫ বার করতে পারলে তার চাহিদা পূরণ করতে হবে এবং তাকে পুরস্কৃত করতে হবে। এছাড়া নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবেঃ
- কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি না করে শিশুটি যা করতে পছন্দ করে তা থেকে তাকে সৃজনশীল কিছু শেখাবার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই শিশুটির পছন্দ- অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে যা দিয়ে খেলছে তাতে যুক্ত হয়ে তাকে শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।
- প্রথমে এমন কিছু নির্বাচন করতে হবে যা শিশুটি করতে সক্ষম হয়। সফলতার জন্য তাকে পুরস্কৃত করতে হবে। চুমু দেয়া, আদর করা, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, তার পছন্দের খাবার/খেলনা প্রদান করা ইত্যাদি কে পুরস্কার হিসাবে প্রদান করা যেতে পারে।
- সকল প্রকার জটিলতা পরিহার করে একটির বেশি বিষয় একত্রে শেখানোর চেষ্টা করার দরকার নেই। যেমন যখন আপেল শেখানোর চেষ্টা করা হয় তখন শুধুই আপেল শেখাতে হবে। বল, টমাটো ইত্যাদি তখন দূরে রাখাই ভালো।
- শেখার সময় শিশুটিকে উৎসাহ দিতে হবে এবং তার ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে। হাত তালি, আদর ইত্যাদির মাধ্যমে উৎসাহিত করা সম্ভব।
- শিশুর অযৌক্তিক আচরণ এবং ভুল শিক্ষাকে অনুমোদন করা ঠিক নয়। অভিমান কিংবা তার দিক থেকে মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাকে সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে।
- কোন ব্যর্থতার জন্য শিশুটিকে মারধর, বকাঝকা, ভয় দেখানো, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং ধৈর্য হারানো যাবে না। তাকে বরং বেশি বেশি স্নেহ-মমতা দিতে হবে।
- অতিরিক্ত চঞ্চলতা, জেদি ও আক্রমণাত্মক আচরণ, নিজেকে আহত করা, ভয় পাওয়া, খিচুনি/মৃগী রোগ ইত্যাদি থাকলে জরুরীভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- অন্যান্য রোগ-বালাই এর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে এবং কোন লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- দাঁতের যত্ন, কান পরিষ্কার ও ব্যক্তিগত হাইজিন এর প্রতি সতর্ক হতে হবে।
এছাড়া মনোযোগ দক্ষতা, অনুকরণ দক্ষতা, ভাষা বোঝা এবং নিজেকে প্রকাশ করার দক্ষতার জন্য যেসব অনুশীলন আছে যেমন-মালাগাঁথা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপ পরা ইত্যাদি নানাবিধ কার্যক্রম এই ধরনের শিশুদের প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অটিজম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা:
১. অটিজম একটি আচরণগত/ আবেগ অনুভূতিগত/ মানসিক স্বাস্থ্যঘটিত ডিজঅর্ডার। এখানে শারীরিক কোন সমস্যা সম্পৃক্ত নয়।
অটিজমের সঙ্গে বিকাশগত অক্ষমতা ও নিউরো-বায়োলজিক্যাল ডিজঅর্ডার জড়িত। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই এটা প্রকাশ পায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি আজীবন এই অক্ষমতার সমস্যায় ভোগে।
২. শিশু বয়সে নেয়া টিকা অটিজমের জন্য দায়ী
অনেকের ধারনা মাম্পস-মিসেলস-রুবেলা (গগজ) ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের ব্যবহারে অটিজম হয়। কিন্তু এটি নিছকই ভুল ধারণা। এ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, কিন্তু কোন যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। তাই ভয় পেয়ে এই ভ্যাকসিন ব্যবহার থেকে বিরত না থেকে বরং বাচ্চাকে ভ্যাকসিন দিলে সে এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকবে।
৩. পিতামাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব সন্তানের অটিজমের জন্য দায়ী।
জন্ম পরবর্তীকালের কোন জটিলতা কিংবা শিশুর প্রতি অমনোযোগিতার ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয় না। কাজেই কোন বাবা মা ও আত্মীয়-স্বজন নিজেদের দোষী ভাবা অথবা বাবা-মাকে দায়ী করার কোন যৌক্তিকতা নেই।
৪. অটিস্টিকদের সবার সমস্যাই একরকম।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। একজনের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল নেই। যেমন কারও আচরণ অ্যাগ্রেসিভ আবার কেউ অতিরিক্ত গুটিয়ে-থাকা স্বভাবের।
৫. এটা একটা সাময়িক সমস্যা; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেরে যাবে। কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার দরকার নেই।
অটিস্টিক শিশু কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠবে না। তারপরও, মৃদু মাত্রার অটিজম, যেমন অ্যাসপারগার সিনড্রোমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষা পেলে পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব। বাকীদের বেলায়, উচ্চমাত্রার অটিজমের ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও অন্যের সাহায্য ছাড়া কখনোই স্বনির্ভর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্ভব নয়।
৬. অটিজম নিরাময়যোগ্য, চিকিৎসা করালে অটিস্টিক ব্যক্তি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং অতি নিবিড় ইনটারভেনশন ও থেরাপির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্যতার এই প্রচারণার সঙ্গে চিকিৎসক-গবেষকরা এখনও একমত হননি।
৭. অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সবারই কোন কিছু শিখতে সমস্যা হয়।
অটিজমে আক্রান্তদের মধ্যে কারো কারো শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা থাকে। কিন্তু কেউ কেউ, বিশেষত অ্যাসপারগার সিনড্রোম আক্রান্তদের অনেকেই, গণিতের মতো বিষয়ে মূলধারার শিশুদের মতোই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। (স্মর্তব্য: অটিস্টিকদের ২০-৩০% অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমে ভোগে)।
৮. অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী।
আইনস্টাইনের অটিজম থাকার প্রসঙ্গ অনেকেই জানেন এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে ভালবাসেন। বাস্তবতা হলো আমেরিকায় শিশুদের প্রতি ১৫০ জনে একজন এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১৬০ জনে একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত। যাদের অধিকাংশই ম্যাথ-জিনিয়াস হওয়া দূরে থাক, খুব সাধারণ দৈনন্দিন কাজকর্মেও অন্যের উপর নির্ভরশীল।
৯. অটিজম থাকলে অন্য কোন ধরণের ডিজঅর্ডার থাকেনা।
অটিস্টিকদের ক্ষেত্রে ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, অন্ধত্ব, বধিরতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা কিংবা অন্য কোন শারীরিক সমস্যা থাকার ঘটনা অস্বাভাবিক তো নয়ই; বরং সাধারণ।
১০. একই পরিবারে অটিজম থাকার ঘটনা একবারের বেশী ঘটেনা।
অটিজম কেন হয়, তার সুস্পষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে জেনেটিক প্রভাব এ রোগের ওপর আছে। সাধারণ যেকোনো শিশুর চেয়ে যাদের ভাই বা বোনের অটিজম আছে, তাদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ধারণা করা হয়, ক্রোমোজোম নম্বর 7q-এর অস্বাভাবিকতার সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক আছে।
অটিজম কি পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব? চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবেন?
অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে অটিজম পুরোপুরি নিরাময় করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কিন্তু সঠিক টেস্ট, চিকিৎসা, থেরাপি এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে শিশুদের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ জীবন আচরণ স্বাভাবিক গন্ডির মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব। বর্তমানে দেশের অনেক শিশুই অটিস্টিক হওয়া সত্তেও স্বাভাবিক জীবনের সাথে মানিয়ে চলতে সক্ষম হচ্ছে। এই জন্য আপনাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে নিউরোজেন। আমাদের আছে দেশের সেরা থেরাপিস্ট, জেনেটিক এক্সপার্ট এবং কাউন্সিলর। তারা আপনার শিশুর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বদ্ধ পরিকর।
Related Blogs
ডিসলেক্সিয়া হল একটি লার্নিং ডিসঅর্ডার, ডিসলেক্সিয়ার লক্ষণ, হবার কারণ এবং চিকিৎসা কি ? ( Md.Ashadujjaman Mondol, Clinical Psychologist )
ডিসলেক্সিয়াঃ মানুষের মাঝে কয়েক ধরনের লার্নিং জনিত সমস্যা দেখা যায়। যেমন- Dyslexia, Dyscalculia, Dysgraphia, and Dyspraxia। এদের মধ...
নিউরোজেন হেলথকেয়ার অন্তর্ভুক্ত জেনেটিক অ্যান্ড জিনোমিক মেডিসিন সেন্টার (𝐆𝐆𝐌C)-এর 𝟐𝟎𝟐𝟑 সালে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন।
𝑮𝒆𝒏𝒆𝒕𝒊𝒄 𝑷𝒊𝒐𝒏𝒆𝒆𝒓𝒔 𝑵𝒆𝒖𝒓𝒐𝑮𝒆𝒏 𝑯𝒆𝒂𝒍𝒕𝒉𝒄𝒂𝒓𝒆 𝑺𝒉𝒂𝒑𝒊𝒏𝒈 𝑻𝒐𝒎𝒐𝒓𝒓𝒐𝒘'𝒔 𝑯𝒆𝒂𝒍𝒕𝒉 𝑻𝒐𝒅𝒂𝒚! • নিউরোজেন হেলথকেয়ার, বিশেষ করে এর অন্তর্ভুক্ত জেনেটিক অ্যান্ড জিনোমিক...
ডিএমডি (DMD) শনাক্তে কয়টি টেস্ট করতে হবে? ডিএমডি ডিলেশন টেস্ট নেগেটিভ হওয়া মানে কি ডিএমডি নেই?
ডিএমডি (DMD) শনাক্তে কয়টি টেস্ট করতে হবে ? ডিএমডি ডিলেশন টেস্ট নেগেটিভ হওয়া মানে কি ডিএমডি নেই ? যারা ডিএমডি জেনেটিক টেস্ট এর রিপোর্ট নিয়ে confused...
জেনেটিকটেস্ট এর বিস্তারিত কোথায় জানবো ? জেনেটিক কাউন্সেলিং কি এবং কিভাবে সাহায্য করে ?
জেনেটিকটেস্ট এর বিস্তারিত কোথায় জানবো ?জেনেটিক কাউন্সেলিং কি এবং কিভাবে সাহায্য করে ? ১। প্রথমত, আমরা জানি জেনেটিক রোগ গুলো হয় খুবই জটিল। একট...
'বাংলাদেশে ডুসেন মাস্কুলার ডিস্ট্রোফি (DMD) ও অন্যান্য পেশিজনিত জেনেটিক রোগের মিউটেশনাল স্পেকট্রাম নির্ণয় ও লক্ষণ পর্যালোচনা'
"Mutational spectrum and phenotypic variability of Duchenne Muscular Dystrophy and related disorders in a Bangladeshi population" টাইটেল: 'বাংলাদেশে...
‘Mutational spectrum and phenotypic variability of Duchenne muscular dystrophy and related disorders in a Bangladeshi population’
Our recent work on DMD titled: ‘Mutational spectrum and phenotypic variability of Duchenne muscular dystrophy and related disorders in a Banglad...