NeuroGen Healthcare
বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ হিউম্যান জিনোমিক স্টাডি সম্পাদন!
► বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ হিউম্যান জিনোমিক স্টাডি সম্পাদন!
জিনগত ত্রুটির কারণে নিউরোডেভ্লপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বা স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা যেমন অটিজম (Autism Spectrum Disorder), Attention-Deficit/Hyperactivity Disorder (ADHD), Intellectual Disability (ID) ইত্যাদি হয়ে থাকে। এই ধরণের জেনেটিক ত্রুটি বাংলাদেশের স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্য থেকে বের করার জন্য একটি বড় পরিসরে গবেষণা সম্পাদিত হয়। সম্প্রতি এই গবেষণাটি আমেরিকান কলেজ অব মেডিক্যাল জেনেটিক্স অ্যান্ড জেনোমিক্সের অফিসিয়াল জার্নাল Genetics in Medicine-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই সম্পূর্ণ গবেষণাটি ঢাকার পান্থপথে অবস্থিত নিউরোজেন হেল্থকেয়ারের অন্তর্ভুক্ত জিনোমিক ল্যাব Genetics & Genomic Medicine Centre (GGMC) -এ সম্পন্ন করা হয়। নিউরোজেনের চিফ সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজার ডক্টর মুহাম্মদ উদ্দীন ডেফিল এর তত্ত্বাবধানে, GGMC-এর ডিরেক্টর হোসনেয়ারা আক্তার এবং তার টিম এই গবেষণার কাজটি চালিয়ে গিয়েছেন ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ যার জনসংখ্যা ১৬৫ মিলিয়নেরও বেশি। এই বৃহৎ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও ক্লিনিকাল জেনোমিক্সের গবেষণায় বিগত ২০১৮ সালের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে বিরল রোগের জেনেটিক কারণগুলি নিয়ে গবেষণা ছিল অপ্রতুল। ২০১৬ সালে নিউরোজেন হেলথকেয়ার বাংলাদেশে একটি জেনেটিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বিরল রোগের যেমন: Tree-Man Syndrome (PMID: 30147876), 15q11.3 imprinted region-based syndrome (PMID: 38616334), Duchenne Muscular Dystrophy ও myopathy (PMID: 38057384), autism (PMID: 32975665), ID (PMID: 31475484) এবং NDD (PMID: 36959829, PMID: 33594065) এর জেনেটিক ত্রুটি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়। এছাড়াও, ক্যান্সার ফিল্ডে নিউরোজেন বাংলাদেশী ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীদের জেনেটিক ত্রুটি বের করতেও সক্ষম হয়েছে (PMID: 31085100, PMID: 31477031)।
► গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নিম্নরূপ:
- অংশগ্রহণকারীদের ৯৮% এর বেশি (৫৬৬/৫৭৬) ছিল শিশু (১৮ বছরের কম)।
- সার্বিকভাবে বাহ্যিক বৈশিষ্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষন ছিল: কথা ও ভাষার উন্নয়নে বিলম্ব, আচরণে অস্বাভাবিকতা, অটিজম, Global Developmental Delay, epilepsy (মৃগী), hypotonia (শরীর নরম থাকা), খাদ্যগ্রহণে জটিলতা, অস্বাভাবিক মুখোমণ্ডল ও বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা।
- মেয়ে শিশুদের মধ্যে প্যাথোজেনিক ভ্যারিয়েন্ট, অর্থাৎ ক্ষতিকারক মিউটেশনের হার, ছেলে শিশুদের তুলনায় বেশি ছিল।
- এই গবেষণায় তিন ধরনের জেনেটিক পরীক্ষা ব্যবহার করা হয়: ৪৪৯ জনের করা হয় ক্রোমোসোমাল মাইক্রোঅ্যারে (CMA), ৩২৯ জনের করা হয় হোল এক্সোম সিকোয়েন্সিং (WES), এবং ১০ জনের জন্য করা হয় লং রিড হোল জেনোম সিকোয়েন্সিং (WGS)।
- CMA -টেকনোলজি দ্বারা বড় সাইজের জেনেটিক পরিবর্তন (>১৫ kb) খুঁজে বের করার মাধ্যমে বেশ কিছু রোগ: Prader-Willi Syndrome, Angelman Syndrome, 16p11.2 Deletion Syndrome, 2q33.1 Deletion Syndrome, Miller-Dieker Syndrome, Williams-Beuren Syndrome ও Down Syndrome শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
- একইভাবে WES -এর মতো টেকনোলজি ব্যবহার করে ছোট ধরণের জেনেটিক পরিবর্তন (SNV, Indel) খুঁজে বের করার মাধ্যমে আরো বেশ কিছু জেনেটিক রোগ যেমন: Developmental and Epileptic Encephalopathy, Dravet Syndrome, Rett Syndrome, Aicardi-Goutieres Syndrome, Noonan Syndrome, Developmental Delay, Impaired Speech and Behavioral Abnormalities, Cohen Syndrome, Intellectual Developmental Disorder ও Coffin-Siris Syndrome নির্ণয় করা হয়েছে।
- প্রচলিত জেনেটিক কারণগুলোর পাশাপাশি, এই গবেষণায় ১১.৬% NDD অংশগ্রহণকারীর মধ্যে নতুন জেনেটিক ত্রুটিও বের হয়ে এসেছে।
- এই প্রথমবার বাংলাদেশি NDD জনগোষ্ঠীর ৩%-এর বেশি মানুষের মধ্যে G6PD (glucose-6-phosphate dehydrogenase) জিনে মিউটেশন নির্ণয় হয়েছে। উক্ত মিউটেশনগুলো ইউরোপীয় NDD জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায়নি। এমনকি Human Genome Diversity Project (HGDP)-এর সুস্থ্য জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পাওয়া যায়নি। গবেষকরা এই মিউটেশনগুলিকে ''Ancient Genetic Draft'' এবং মানসিক বিকাশজনিত সমস্যার সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ জিন হিসেবে বিবেচনা করছেন। কারণ, G6PD জিনের ত্রুটির ফলে মানবদেহে এনিমিয়া হয়, যা স্নায়ুকোষে অক্সিজেনের স্বল্পতার সৃষ্টি করে। এবং এর ফলে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
- ৫৭৬ জন শিশুদের বিশাল এই গ্রুপের মধ্যে ১৬% ক্ষেত্রে অভিভাবকরা ছিলেন নিকটাত্মীয়ের মাঝে বিবাহিত দম্পতি, অর্থাৎ consanguineous marriage। Consanguineous marriage বলতে বোঝানো হয় ফার্স্ট ডিগ্রি কাজিন অর্থাৎ আপন খালাতো ভাই-বোন, চাচাতো ভাই-বোন অথবা মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোন, যাদের মধ্যে বিবাহ হলে সন্তানদের মাঝে বেশ কিছু জেনেটিক রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এমনকি এই গবেষণার ক্ষেত্রেও এরূপ দম্পতিদের সন্তানদের মাঝে অধিক জেনেটিক রোগের প্রবণতা দেখা গিয়েছে (৪৮%) ।
- অংশগ্রহণকারীদের বিভাগভিত্তিক বণ্টনে দেখা গেছে যে রাজশাহী বিভাগে পারিবারিক বিবাহের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (৩২%), যেখানে জেনেটিক রোগ নির্ণয়ের হারও সর্বোচ্চ।
- NDD-এর সাথে সম্পৃক্ত জেনেটিক ত্রুটি ছাড়াও এই গবেষণার মাধ্যমে ৩.৩% অংশগ্রহণকারীদের মাঝে অন্য রোগে আক্রান্ত হবার জেনেটিক ত্রুটিও বের হয়ে এসেছে, যেমন- থ্যালাসিমিয়া, ক্যান্সার, চোখের সমস্যা ও নিউমোনিয়া।
- আমাদের গবেষণায় তিনটি ভিন্ন জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (NDD)-এর মাঝে পূর্বে নির্ণয় হয়েছে এমন ও নতুন জেনেটিক ত্রুটি গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্যসেবায় নতুন উদ্ভাবনার আশ্বাস দেয় যা বিরল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবাকে উন্নত করবে। এছাড়াও, গবেষণার ফলাফলগুলো একত্রে বহু জটিল রোগ দ্রুত ও নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে সহায়ক, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। দ্রুত রোগ নির্ণয় স্বাস্থ্য সেবার খরচ এবং পরিবারে মানসিক চাপ উভয়ই কমাতে সক্ষম।
- এই গবেষণাটি বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে জেনেটিক্সের অগ্রগতির পথে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হতে পারে। নেক্সট-জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মতো আধুনিক জেনোমিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে, বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোগ নির্ণয়ে আরও অগ্রসর হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। একই সঙ্গে, ভবিষ্যতে প্রিসিশন মেডিসিনের বিকাশের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। আমরা বিশ্বাস করি, এমন উদ্ভাবনী গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অবদান থাকবে।